নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও হয়রানিমূলক আচরণ একটি বৈশ্বিক ইস্যু। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশের বেশি দেশে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিষিদ্ধ করে কোনো আইন নেই। কর্মক্ষেত্রে কোটি কোটি কর্মজীবী নারী যৌন হয়রানির ঝুঁকিতে রয়েছে। তবুও কর্মক্ষেত্রে নারীদের এই ধরনের হয়রানি থেকে সুরক্ষা করতে সুর্নিদিষ্টভাবে কোনো আন্তর্জাতিক মানসম্মত আইন নেই।
কর্মক্ষেত্রে নারীদের হয়রানি নিয়ে জরিপ পরিচালনা করেছে ‘কেয়ার বাংলাদেশ’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)। সংস্থাটির গবেষণা মতে, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই অর্থাত্ ৮৪ দশমিক ৭ শতাংশের মৌখিকভাবে হয়রানির হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। মৌখিক হয়রানির মধ্যে রয়েছে নারীদের ধমক, বকাঝকা করা ও তাদের বিরুদ্ধে অবাঞ্চিত ভাষার ব্যবহার। এসব শ্রমিক অভিযোগ করেছেন, কর্তৃপক্ষ নিয়মিত তাদের বকাঝকা করেন। প্রায়ই তাদের বাবা-মা তুলে গালিগালাজসহ অবাঞ্চিত সব কথা-বার্তা শুনতে হয়। অধিকাংশ উত্তরদাতা তথা ৭১ দশমিক ৩ শতাংশই স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে মানসিক হয়রানির শিকারও হয়েছেন। মানসিক হয়রানির মধ্যে রয়েছে চাকরি থেকে বহিষ্কার করার হুমকি-ধামকি দেওয়া। হঠাত্ কাজের প্রেসার ও টার্গেট বাড়িয়ে দেওয়া ও টার্গেট পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ফ্যাক্টরি ত্যাগের অনুমতি না দেওয়া। এ বিষয়গুলোকে মানসিক হয়রানির অংশ বলে মনে করেন শ্রমিকরা। পাশাপাশি শ্রমিকরা আরও অভিযোগ করেছেন, সামান্য কোনো ধরনের ভুলত্রুটি হলেই প্রায় তাদের অন্যদের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় যা তাদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করে।
যৌন হয়রানির ধরনের উল্লেখ করতে গিয়ে নারী শ্রমিকরা বলছেন, তারা মনে করেন যৌন হয়রানি সবচেয়ে সাধারণ ধরন হলো তাদের শরীরে অপ্রত্যাশিত ভাবে স্পর্শ করা (যেমন: মুখ, ঘাড়, মাথা ও পিঠ) এবং অবাঞ্চিত ভাষার ব্যবহার করা। কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের অনেকে প্রায়ই মেয়ে শ্রমিকদের হাত ধরে থাকে এবং তাদের ভালোবাসা সম্পর্কিত অবৈধ প্রস্তাব দেওয়া হয়। যাকে যৌন হয়রানির একটি অংশ বলে মনে করেন নারী শ্রমিকরা।
কর্মক্ষেত্রে নারীরা বিশেষভাবে সহিংসতায় ঝুঁকিপর্ণ হওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো নারী ও পুরুষের মাঝে প্রকাশভঙ্গি/প্রভাবাধীন করার গুণাগুণের পার্থক্য। যৌন পার্থক্যের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের কর্ম নির্ধারণ কর্মক্ষেত্র সহিংসতাকে দুভাবে শক্তিশালী করছে। আর তা হলো সংগঠন বা কোম্পানিতে কর্মরত অবস্থায় সহকর্মী পর্যায়ে এবং কোম্পানির ঊর্ধ্বতন-অধস্তন কর্মকতা পর্যায়ে যৌন সহিংসতা। অন্যদিকে ভালো পারিশ্রমিক, ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের পদে নিয়োগ এবং সেই সাথে দেখভাল (সুপারভাইজার) করার মতো জায়গাগুলোতে পুরুষদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। আর অধিকাংশ নারীদের স্বল্প মজুরি দেওয়া হয় এবং তাদের এমন ধরনের নিম্ন পর্যায়ের কাজ দেওয়া হয় যেখানে তাদের নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা নাই বলতে গেলেই চলে।
কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ক্ষমতার পার্থক্য রয়েছে। কারখানায় অধিকাংশ নারীরা নিছক কর্মচারী হিসেবে কাজ করে আর পুরুষদের অধিকাংশই ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে কাজ করে থাকে। উপরন্তু উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য মেয়েদের ওপর উচ্চ মাত্রায় কাজের চাপ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এসব বিষয়কে বৈরী কর্মপরিবেশ তৈরির পেছনে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার শিকার নারীরা সামাজিক কলঙ্ক এড়াতে সহিংসতার ঘটনায় খুব কমই অভিযোগ করে থাকে। মেয়ে লোকজন তাদের বিশ্বাস করতে না পারে এই ভয়ে অভিযোগ করে না। তাদেন শঙ্কা অভিযোগ দিলে সহকর্মীরা তাদের এড়িয়ে চলবে, চাকরি চলে যেতে পারে ও তাকে আরও সহিংসতার শিকার হতে পারে। সর্বশেষ বিষয় হলো সামাজিক নিয়ম কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতার সূত্রপাত্র ঘটিয়েছে। কেননা পিতৃতান্ত্রিক নিয়ম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মক্ষেত্রে নারীদেন পরাধিনতাকে বাড়িয়ে তুলছে।
গবেষণায় দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে মূলত সহিংসতার দু ধরনের প্রভাব রয়েছে; আর্থিক ও ব্যক্তিগত। মার্কিন এক জরিপে অনুমান করা হয়, যৌন হয়রানির শিকার কর্মচারীদের পেছনে মাথা পিছু খরচ হয় ২২ হাজার ৫শ’ মার্কিন ডলার। যার বেশিরভাগ খরচ বহন করতে হয় মালিকদের (উইলনেস, স্টিল অ্যান্ড লি ২০০৭)। এই খরচের মধ্যে রয়েছে আইনি খরচ, উত্পাদনশীলতার ক্ষতি ও স্বাস্থ্য ব্যয়। এছাড়া মালিকরা অনুপস্থিত, কাজের দুর্বল পারফরমেন্স ও উত্পাদনশীলতা কমে যাওয়ার মতো অদৃশ্য খরচের সম্মুখিন হন। আর এমন পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্য শ্রমিকদের ওপর প্রভাব ফেলে। ফলে তাদের কাজও ব্যাহত হয়। এতেও ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়। আবার চাকরি থেকে অব্যাহতি ও বরখাস্তের কারণে পুনরায় সেখানে নতুন কর্মচারী নিয়োগে বাড়তি খরচের ঝামেলা পোহাতে হয় কর্তৃপক্ষকে।
এছাড়া কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা হুমকিও রয়েছে। অপরাধীরা সরাসরি মুখোমুখি সংঘাত বা উত্ত্যক্ত, শারীরিক অথবা যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো কৌশল নিয়ে থাকে। এসব আচরণ কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা, প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ ও কর্মচারীদের ভালো থাকার অনুভূতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।